একজন নাগরিক রাষ্ট্রকে তার উপার্জিত অর্থের বিপরীতে যে কর দিয়ে থাকেন, সাধারণভাবে সেটিই আয়কর। সরকারের আয়েরও অন্যতম উৎস এই আয়কর, যেটি মূলত সংগ্রহ করে থাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতি অর্থবছরের শুরু থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত আয়কর জমা দেওয়ার সুযোগ থাকে। এই আয়কর জমা দেওয়ার জন্য আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ করে তারপর প্রযোজ্য করের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়। তবে এই আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণের বিষয়টিই অনেকের কাছে, বিশেষ করে নতুন করদাতার কাছে জটিল হয়ে উঠতে পারে।করদাতারা যেন সহজে রিটার্ন ফরম পূরণ করে রিটার্ন দাখিলের পদ্ধতিগুলো জানতে পারে, সেই বিষয়টি নিয়ে আজকের আলোচনা।
আয়কর কত প্রকার :-
আয়কর দুই প্রকার
১/ একটি প্রত্যক্ষ কর।
২/ পরোক্ষ কর।
প্রত্যক্ষ কর হলো ( Income Tax) বা আয়কর, যেটি আয় করলেই দিতে হবে । যেমন— একজন পুরুষ নাগরিক বছরে তিন লাখ টাকার বেশি আয় করলে তাকে কর দিতে হবে। তবে নারী, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী এবং তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকরা সাড়ে তিন লাখ টাকা উপার্জনের জন্য আয়কর থেকে অব্যাহতি পাবেন । তারা বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি আয় করলে তাদের আয়কর দিতে হবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য এই আয়করমুক্ত সীমা সাড়ে চার লাখ টাকা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চার লাখ ৭৫ হাজার টাকা। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যিনিই এই আয়সীমা অতিক্রম করবেন, তাকেই আয়কর দিতে হবে।
প্রতিটি নাগরিককেই আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এটি বাধ্যতামূলক। রিটার্ন ফরম পূরণের পর যদি দেখা যায় যে তার ওপর আয়কর প্রযোজ্য, তাহলে তিনি আয়কর দেবেন । আর রিটার্ন দাখিলের হিসাবে যদি দেখা যায় যে তার ওপর আয়কর প্রযোজ্য নয়, তাহলে তাকে আয়কর দিতে হবে না।
আয়কর জমা দেওয়ার জন্য যে আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ করতে হয়, যেকোনো কর অঞ্চলের যেকোনো সার্কেল অফিসে গিয়ে বিনামূল্যে ফরমটি সংগ্রহ করতে পারবেন । তবে কেউ যদি অফিসে না যেতে চান, তারা এনবিআরের ওয়েবসাইট থেকেও এই ফরমটি ডাউনলোড করে নিতে পারবেন । ব্যক্তি ও কোম্পানির জন্য আলাদা আলাদা ফরম রয়েছে। ফরমগুলো বাংলা ও ইংরেজি— দুইটি ভাষাতেই পাওয়া যাবে।
আমরা অনেকেই ধরে নেই নভেম্বর মাসেই শুধু আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয় । এটি ঠিক নয় । আমাদের অর্থবছর শুরু হয় প্রতিবছরের ১ জুলাই থেকে। ওই দিন থেকে শুরু করে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাস আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার নিয়মিত সময়। এর মধ্যেও কেউ যদি কোনো কারণে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করতে পারেন, তার জন্যও সুযোগ রয়েছে। তিনি একটি ফরম পূরণ করে রিটার্ন দাখিলের জন্য আরও দুই মাস সময় নিতে পারবেন । সেক্ষেত্রে তার ওপর যে পরিমাণ কর প্রযোজ্য, সেটির ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে ।
গত বছর বাদ দিয়ে আগের কয়েক বছরেই এনবিআর নভেম্বর মাসের যেকোনো একটি সপ্তাহে দেশব্যাপী করমেলা আয়োজন করেছে । এ কারণেই অনেকেই নভেম্বর মাসকেই আয়কর রিটার্নের নির্ধারিত সময় মনে করে থাকেন । তবে এই কর কমিশনার সবার প্রতি জুলাই-আগস্টের মধ্যেই আয়কর রিটার্ন দাখিল করার আহ্বান জানিয়েছেন। কেননা, অর্থবছরের শুরুর এই সময়ে কর অফিসগুলোতে ভিড় কম থাকে।
ব্যক্তিশ্রেণি ও অন্যান্য করদাতার জন্য আয়কর রিটার্নের ফরমটি আট পৃষ্ঠার একটি ফরম । এতে শুরুতেই সার্বজনীন স্বনির্ধারণী ঘরটি পূরণ করতে হবে। অর্থাৎ এই ফরমের মাধ্যমে করদাতা নিজেই নিজের করের হিসাবগুলো করছেন। পরবর্তী সময়ে এই হিসাব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে বা হিসাবে ভুল থাকলে এনবিআর নিজেই করদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
ফরমের প্রথম পৃষ্ঠায় করদাতার নাম, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, ই-টিআইএন নম্বর, কর সার্কেল, কর্মরত প্রতিষ্ঠানসহ বর্তমান ও স্থানীয় ঠিকানা এবং ফোন নম্বরের ঘরগুলো পূরণ করতে হবে। ফরমটিতে কোনো সমস্যা পাওয়া গেলে ওই বর্তমান ঠিকানা ও ফোন নম্বরেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে ।
ফরমের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় করদাতার উপার্জনের বিভিন্ন তথ্য পূরণ করতে হবে । চাকরিজীবী হলে তার বেতন, বাড়ি থাকলে তা থেকে আয়, কৃষি জমি থেকে আয়, ব্যবসা বা অন্য কোনো পেশা থাকলে সেখান থেকে আয়, অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান কিংবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্বামী/স্ত্রীর আয়গুলোও এই পৃষ্ঠায় পূরণ করতে হবে । এর সঙ্গে অন্যান্য খাত এবং বিদেশ থেকে কোনো আয় থাকলে সেটি পূরণের জন্য পৃথক ঘর রয়েছে । করদাতা কর রেয়াতের সুবিধা প্রাপ্য হলে সেসব তথ্য পূরণের জন্যও রয়েছে আলাদা ঘর । করদাতা উৎসে করসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আগে থেকেই কর পরিশোধ করে থাকলে তার তথ্যও এই পৃষ্ঠাতেই দেওয়া নির্দিষ্ট ঘরে পূরণ করতে হবে।
আয়কর রিটার্ন ফরমের তৃতীয় পৃষ্ঠায় করদাতার বেতন ও ঘরবাড়ি থেকে উপার্জনের তথ্য পূরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেতনের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু পরিমাণ পর্যন্ত কর অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বাড়ি থাকলে তার মেরামতসহ বিভিন্ন কাজে খরচগুলোও কর অব্যাহতির আওতায় আসবে। চতুর্থ পৃষ্ঠায় জীবন বিমা থেকে শুরু করে ভবিষ্য তহবিল, ঋণ, ডিপোজিট স্কিম, কল্যাণ তহবিল, জাকাত তহবিলসহ বিভিন্ন খাতে খরচের তথ্যগুলো তুলে ধরতে হবে। বিভিন্ন আয়-ব্যয়ের তথ্যপ্রমাণ সম্বলিত যেসব নথিপত্র ফরমের রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করতে হবে, তার বিবরণও তুলে ধরতে এই পৃষ্ঠাতেই।
রিটার্ন ফরমের পরের তিন পৃষ্ঠায় করদাতার পরিসম্পদ, দায় ও ব্যয়ের বিবরণী তুলে ধরতে হবে। সেক্ষেত্রে করদাতা ব্যবসায়ী হলে তার পুঁজি, কৃষি সম্পত্তি থাকলে সেখানে আয়-ব্যয়ের পরিমাণ, বিনিয়োগ থাকলে তার ধরন ও পরিমাণ, আসবাবপত্র, অলংকার, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ব্যবসা বহির্ভূত অর্থসম্পদ (নগদ বা ব্যাংকে গচ্ছিত) ইত্যাদি তথ্য দিতে হবে । সম্পদ বা জমি বন্ধক, জামানতবিহীন ঋণদায়, ব্যাংক ঋণসহ করদতার অন্যায় দায়ের তথ্যও দিতে হবে । একইসঙ্গে পরিবারে নির্ভরশীল সদস্যের সংখ্যা, সম্পদের মোট পরিবৃদ্ধি, অর্জিত তহবিলের তথ্যও পূরণ করতে হবে।
আর শেষ পাতায় পূরণ করতে হবে ব্যক্তিগত ও ভরণপোষণের খরচ, উৎসে কর কর্তনসহ আগের অর্থবছরে পরিশোধিত আয়কর, আবাসন সংক্রান্ত খরচ, ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ, আবাসিক বিদ্যুৎ, আবাসিক গ্যাস বিল, আবাসিক টেলিফোন বিল, সন্তানদের লেখাপড়া খরচ, বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত খরচ, উৎসব ব্যয় ইত্যাদির তথ্য।
আয়কর রিটার্নের আগে কর পরিচিতি নম্বর (ট্যাক্স আইডেন্টিফিরেকশন নম্বর) বা টিআইএন নম্বর নিতে হয় নাগরিকদের। এখন এটি অনলাইনেই করা যায় বলে একে ই-টিআইএন’ও বলা হয়। প্রত্যেকের জন্য ইউনিক একটি নম্বর, যা একজনের সঙ্গে আরেক জনের মিলবে না । এর আগে এটি ১০ ডিজিটের একটি নম্বর ছিল । এখন সবাইকে ১২ ডিজিটের ই-টিআইএন নম্বর দেওয়া হয়ে থাকে । কর দিতে আগ্রহী কেউ নিবন্ধন করতে চাইলে এনবিআরের ওয়েবসাইটে গিয়ে ই-টিআইএন সার্ভারে যেতে পারবেন। যেখানে গিয়ে তার জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে নিবন্ধন করে নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে মোবাইল নম্বরে একটি ওটিপি (ওয়ান টাইম পাওয়ার্ড) আসবে। সেটি ব্যবহার করে সহজেই নিবন্ধন করে নেওয়া সম্ভব।
কেউ যদি মারা যান, তার সবশেষ কর বছরের কর মামলা নিষ্পত্তির পর তার পক্ষে আর কাউকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে না। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুসনদ, ওয়ারিশন সার্টিফিকেট বা বণ্টননামা থাকলে দাখিল করলেই চলবে । আর যদি কোনো করদাতা দেশের বাইরে থাকেন, তাহলে তারা ওই দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে যথাসময়ে রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। তবে কোনো করদাতা সেটি করতে অসমর্থ হলে দেশে ফেরার তিন মাসের মধ্যে সব প্রমাণসহ আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
ধন্যবাদান্তে,
জুরিস্ট কমিউনিকেশন ল ফার্ম
মোবাইলঃ 01886012863
ইমেইলঃ juristcommunication@gmail.com